মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১৭ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করার মামলায় কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক ৭ সদস্যকে ১২ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। একইসাথে দন্ডিত আসামীদের প্রত্যেককে ৩ লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদয়ে আরো ২ বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় দন্ডিত ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে ১২ বছর কারাদন্ডের মধ্যে দন্ড বিধির ৩৮৬ ধারায় আসামী ৭ পুলিশ সদস্যের প্রত্যেককে দোষী সাব্যস্থ করে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড, একইসাথে প্রত্যেককে দুই লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরো এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। এছাড়া, ফৌজদারী দন্ড বিধির ৩৬৫ ধারায় আসামীদের দোষী সাব্যস্থ করে ৫ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। একইসাথে প্রত্যেককে আরো এক লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরো এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। ২ টি ধারায় প্রদত্ত শাস্তি একইসাথে চলবে বলে বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল রায়ে উল্লেখ করেছেন।
দন্ডিত আসামীরা হচ্ছে-কক্সবাজার জেলা পুলিশের ডিবি’র সাবেক সদস্য হলেন-এসআই মোঃ আবুল কালাম আজাদ, এসআই মোঃ মনিরুজ্জামান, এএসআই মোঃ গোলাম মোস্তফা, এএসআই মোঃ ফিরোজ, এএসআই আলাউদ্দিন, কনস্টেবল মোস্তফা আজম এবং কনস্টেবল আল আমিন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি ও রাষ্ট্র পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ সিবিএন-কে এ তথ্য জানিয়েছেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর কক্সবাজার ডিবি পুলিশের ৭ সদস্য টেকনাফ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জালিয়া পাড়ার মৃত হোসেন আহমদ এর পুত্র মোঃ আবদুল গফুর (৩২) কে কক্সবাজার ডিবি পুলিশের ৭ সদস্য কক্সবাজার শহরের ‘আল গণি’ হোটেলের সামনে থেকে অপহরণ করে টেকনাফ নিয়ে যায়।
পুলিশ সদস্যরা অপহৃত মোঃ আবদুল গফুরকে মারধর করে ‘ক্রস ফায়ার’ এ হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে মোঃ আবদুল গফুরের স্বজনেরা ডিবি পুলিশের সদস্যের ১৭ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দিলে অপহরণ অবস্থা থেকে মোঃ আবদুল গফুরকে ডিবি পুলিশ ছেড়ে দেয়।
পরে বিষয়টি মোঃ আবদুল গফুরের স্বজনেরা টেকনাফের লম্বরী সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে কর্মরত সেনা সদস্যদের জানায়। টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে চেকপোস্টের সেনা সদস্যরা মুক্তিপণ আদায়কারী ডিবি পুলিশের সদস্যদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি তল্লাশি করে ১৭ লাখ নগদ টাকা পান। এ সময় এসআই মোঃ মনিরুজ্জামান মাইক্রোবাস থেকে পালিয়ে গেলেও বাকী ৬ পুলিশ সদস্যকে আটক করা হয়।
এ ঘটনায় মোঃ আবদুল গফুর বাদী হয়ে ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর মুক্তিপণ আদায়কারী ৭ পুলিশ সদস্যকে আসামী করে ফৌজদারী দন্ড বিধির ৩৬৫/৩৮৫/৩৮৬/৩৪ ধারায় টেকনাফ থানায় মামলা দায়ের করেন। যার টেকনাফ থানা মামলা নম্বর : ৩৮/২০১৭ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর : ৭৮৯/২০১৭ (টেকনাফ) এবং এসটি মামলা নম্বর : ১০২১/২০১৯ ইংরেজি। মামলার পর উল্লেখিত ৭ পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে বহিস্কার করা হয়।
বিচার ও রায় :
মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে ৭ পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট আদালতে চার্জশীট প্রদান করে। চার্জশীট নম্বর : ৩৮৪। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর মামলাটির চার্জ (অভিযোগ) গঠন করে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে ২১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এছাড়া, মামলায় আসামীদের পক্ষে সাক্ষীদের জেরা, আলামত প্রদর্শন, যুক্তিতর্ক সহ বিচারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ফৌজদারী দন্ড বিধির ৩৮৬ ধারায় আসামী ৭ পুলিশ সদস্যের প্রত্যেককে দোষী সাব্যস্থ করে ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড, একইসাথে প্রত্যেককে দুই লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরো এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। এছাড়া ফৌজদারী দন্ড বিধির ৩৬৫ ধারায় আসামীদের সাবেক ৭ পুলিশ সদস্যকে দোষী সাব্যস্থ করে ৫ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। একইসাথে প্রত্যেককে এক লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরো এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। ২ টি ধারায় প্রদত্ত শাস্তি একইসাথে চলবে বলে বিজ্ঞ রায়ে উল্লেখ করেছেন।
রায়ের পর্যবেক্ষনে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, আসামিরা পুলিশ সদস্য হয়েও উন্নত ও আধুনিক প্রশিক্ষণ পায়নি। এজন্য, আসামীদের নৈতিকতাবোধ ও শিষ্টাচারের যথেষ্ট অভাব থাকায় অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের দিকে তারা ধাবিত হয়েছে। বিজ্ঞ বিচারক বলেন, পুলিশ সদস্যের দৃঢ় মনোবল, নৈতিকতা ও সেবাধর্মী মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন হওয়া দরকার। এজন্য পুলিশ সদস্যদের সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নত প্রশিক্ষণ সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল পর্যবেক্ষনে আরো বলেন, মামলাটি সাক্ষ্য, প্রমাণে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামীদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আসামীদের অধিকতর কম বয়স, সকলে এখনো তরুণ বিবেচনায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় পরও তাদের অপেক্ষাকৃত কম সাজা প্রদান করা হয়েছে।
প্রসিকিউন পক্ষে মামলা পরিচালনায় আরো ছিলেন- সাবেক পিপি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। আসামীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট আলহাজ্ব শামছুল আলম কুতুবী, অ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার দাশ ও অ্যাডভোকেট আশরাফুল আলম চৌধুরী।
রায়ের পর পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ বলেন, রাষ্ট্র পক্ষ আদালতে সাক্ষী, সকল তথ্য, উপাত্ত যথাসময়ে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।রাষ্ট্র পক্ষ আদালতে মামলাটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আদালত স্পর্শকাতর এ মামলাটি যথাযথ রায় ঘোষণা করতে পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।